গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী একান্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই খাতে চলমান ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রবাহে যেমন রয়েছে অসাধারণ সম্ভাবনা, তেমনি রয়েছে কিছু অযৌক্তিকতা। তিনি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, যে কোনো সময় এই বিনিয়োগের বুদ্বুদ ফেটে গেলে তার প্রভাব থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানই সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে না।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এআই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মূল্য নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান এই খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করায় সিলিকন ভ্যালিসহ বিশ্বজুড়ে সম্ভাব্য একটি বুদ্বুদ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রযুক্তি জায়ান্টটি কতটা স্থিতিশীল থাকতে পারবে, এমন প্রশ্নে অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী স্বীকার করেন যে তারাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। তাঁর ভাষায়, কোনো প্রতিষ্ঠানই এর প্রভাব এড়াতে পারবে না, অ্যালফাবেটও নয়।
ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তরে দেওয়া বিস্তৃত এই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও কথা বলেন শক্তির চাহিদা, জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ধীরগতি, যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগ, তাদের এআই মডেলের নির্ভুলতা এবং কর্মসংস্থানের ওপর এআই বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে। এআই বাজারের বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি এই আলোচনাকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
গত সাত মাসে অ্যালফাবেটের বাজার মূল্য দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তিন দশমিক পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সার্চ বাজারে প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় প্রতিষ্ঠানটি যথেষ্ট দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে বলে আস্থার ভিত্তিতেই এই উত্থান। পাশাপাশি, তারা যে বিশেষায়িত এআই সুপারচিপ তৈরি করছে, তা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নামছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আরেক মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট, যার প্রধান নির্বাহী সম্প্রতি পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন।
এআই-সংক্রান্ত বিনিয়োগ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে সংশয়ও। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, যেভাবে অন্তত এক দশমিক চার ট্রিলিয়ন ডলারের জটিল লেনদেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হচ্ছে, তা বাস্তব আয়ের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। অনেকের আশঙ্কা, নব্বই দশকের শেষ দিকে ডটকম বুদ্বুদ যেভাবে তৈরি হয়েছিল এবং ২০০০ সালে যেভাবে তা ভেঙে পড়েছিল, এবার এআই বাজারও তেমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে।
ডটকম বুদ্বুদের সময় অতিরিক্ত আশাবাদের কারণে বহু কোম্পানির মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, পরে বাজার ধসে বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং হাজারো মানুষ চাকরি হারায়। বড় ধস বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয় এমনকি অবসর তহবিলকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী বলেন, প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের চক্রগুলো মাঝে মাঝে বাস্তব প্রয়োজনের তুলনায় বেশি দূর পর্যন্ত ছুটে যেতে পারে। তাঁর মতে, যেমনভাবে ইন্টারনেট উদ্ভাবনের সময় অতিরিক্ত বিনিয়োগ হয়েছিল, তবুও আজ কেউ এর প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। এআই-ও একই পথেই এগোবে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর এক সতর্কবার্তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় তার মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, এআই-এ বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত ফল দেবে বটে, কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী দাবি করেন, প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব প্রযুক্তি অবকাঠামো, ডেটা, মডেল এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার পূর্ণ সমন্বিত কাঠামো তাদের বাজারের অস্থিরতা মোকাবিলায় তুলনামূলক শক্তিশালী অবস্থানে রাখবে।
এআই-এ যুক্তরাজ্যের ভূমিকা বাড়াতে অ্যালফাবেটের বড় পরিকল্পনার কথাও তিনি জানান। গত সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা করে যে আগামী দুই বছরে তারা দেশটিতে পাঁচ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করবে। লন্ডনে অবস্থিত তাদের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ইউনিটকেও আরও শক্তিশালী করা হবে। তিনি আরও জানান, প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যেই তারা ভবিষ্যতে তাদের এআই মডেল প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করবে, যা দেশটিকে বৈশ্বিক এআই শক্তিতে পরিণত করার সরকারি লক্ষ্যকে এগিয়ে নেবে।
তবে এআই প্রযুক্তি যেমন অগ্রগতি আনছে, তেমনি বাড়ছে শক্তি ব্যবহারের চাপ। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বব্যাপী মোট বিদ্যুতের এক দশমিক পাঁচ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে এআই-এর চাহিদা মেটাতে। অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী সতর্ক করে বলেন, শক্তির এই বিশাল চাহিদা পূরণে নতুন উৎস ও অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। তিনি আরও স্বীকার করেন, এআই বিস্তারের কারণে তাদের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে, যদিও ২০৩০ সালের মধ্যে নিট শূন্য নির্গমন অর্জনের লক্ষ্য অপরিবর্তিত রয়েছে।
এআই-এর প্রভাব কর্মক্ষেত্রেও গভীরভাবে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, এটি মানবজাতির সবচেয়ে গভীর প্রভাববাহী প্রযুক্তি। অনেক পেশায় পরিবর্তন আসবে, নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং কর্মীদের এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষকের থেকে শুরু করে চিকিৎসক পর্যন্ত যে কোনো পেশাতেই যারা এআই ব্যবহার শিখবে, তারাই ভবিষ্যতে এগিয়ে থাকবে।



