ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন স্টিল শুল্ক নীতির ঘোষণা ঘিরে চরম উদ্বেগ ছড়িয়েছে মহাদেশের অটোমোবাইল খাতে। স্টিল আমদানিতে সীমাবদ্ধতা এবং উচ্চ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব প্রকাশের পর থেকেই ইউরোপের বড় গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরে বড় ধরনের পতন লক্ষ্য করা গেছে।
ইউরোপীয় কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, স্থানীয় স্টিল শিল্পকে রক্ষার লক্ষ্যে স্টিল আমদানির কোটা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হবে এবং শুল্ক হার দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করা হবে। প্রস্তাবিত নতুন কোটা অনুযায়ী, প্রতিবছর মাত্র ১৮.৩ মিলিয়ন টন পর্যন্ত ট্যারিফমুক্ত স্টিল আমদানি করা যাবে—যা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ৪৭ শতাংশ কম। এর বেশি আমদানির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। কমিশনের এই উদ্যোগকে বলা হচ্ছে “ইউরোপীয় স্টিল শিল্পের জন্য শক্তিশালী ও স্থায়ী সুরক্ষা”।
তবে এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইউরোপের গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। অটোমোবাইল সেক্টর মনে করছে, নতুন শুল্ক নীতি তাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে এবং বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
বুধবার লন্ডন সময় দুপুরে ইউরোপের স্টক্স অটোমোবাইলস অ্যান্ড পার্টস ইনডেক্স প্রায় ১.৭ শতাংশ পতন ঘটিয়ে নিচে নেমে আসে—যা সেদিন ইউরোপের অন্যতম বড় সূচকীয় ক্ষতি বলে বিবেচিত হয়েছে।
ইউরোপিয়ান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (ACEA) জানিয়েছে, ইউরোপের গাড়ি নির্মাতারা তাদের প্রায় ৯০ শতাংশ স্টিল সরাসরি ইউরোপীয় বাজার থেকেই সংগ্রহ করে থাকে। সংগঠনের মহাপরিচালক বলেন, “আমরা বুঝি স্টিল শিল্পের কিছুটা সুরক্ষা প্রয়োজন, তবে কমিশনের প্রস্তাবিত কাঠামো বাস্তবে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এতে ইউরোপীয় বাজারে স্টিলের দাম বেড়ে যাবে, যা সরাসরি গাড়ি উৎপাদনের ব্যয়ে প্রভাব ফেলবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের মতে, এই নীতিতে স্টিল উৎপাদক এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে ভারসাম্য থাকা উচিত। একতরফা সুরক্ষা দীর্ঘমেয়াদে শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
এদিকে, ঘোষণার পর জার্মানির অন্যতম বড় গাড়ি নির্মাতা বিএমডব্লিউ–এর শেয়ারদর হঠাৎ করেই প্রায় ৬.৫ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে যায়। গত এক বছরের মধ্যে এটি তাদের সবচেয়ে খারাপ বাণিজ্যিক দিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কোম্পানিটি সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চীনা বাজারে ধীর প্রবৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্কের চাপ তাদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে।
পরিবহন ও লজিস্টিক খাতের একজন জ্যেষ্ঠ অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, বিএমডব্লিউ–এর এই সতর্কবার্তা ইউরোপের গাড়ি শিল্পের সামনে থাকা বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলোরই প্রতিফলন। দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনে যেখানে কিছুটা আশাবাদ দেখা গিয়েছিল, এখন সেই আত্মবিশ্বাস ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
জার্মানির অন্যান্য শীর্ষ ব্র্যান্ড যেমন মার্সিডিজ-বেঞ্জ, পোর্শে এবং ভলকসওয়াগনের শেয়ারদরও এক শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। ফ্রান্সের রেনল্টের শেয়ারদর নেমে গেছে প্রায় ২.৩ শতাংশ এবং মিলান–ভিত্তিক স্টেলান্টিসের দরও কমেছে প্রায় ০.৭ শতাংশ।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রি-মার্কেট ট্রেডে ফোর্ড ও স্টেলান্টিসের শেয়ার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল, যদিও সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় অটোমোবাইল বাজারে এর প্রভাব খুবই সীমিত।
শিল্প বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন এই শুল্কনীতি যদি কার্যকর হয়, তবে তা গাড়ি শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। বাড়বে উৎপাদন খরচ, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার উপরই প্রভাব ফেলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় স্টিল শিল্পকে রক্ষা করতে গিয়ে ইউরোপ হয়তো নিজের অন্যতম শক্তিশালী শিল্প খাত—অটোমোবাইল উৎপাদন—কে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, কমিশন কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে উভয় খাতের স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারে।



