ইউক্রেনের দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ লড়াই এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে দ্রুত আর্থিক সহায়তা ছাড়া দেশটির প্রতিরক্ষা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থন দৃঢ় না হলে রুশ আগ্রাসনের সামনে কিয়েভ মারাত্মক দুর্বল অবস্থায় দাঁড়াবে। বছরের শুরুতে মিউনিখে ইউরোপীয় নেতাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্টের কঠোর সমালোচনা এবং কিয়েভ নেতৃত্বের প্রতি ওয়াশিংটনে প্রকাশ্য প্রশ্নবানে ইউক্রেন ইইউ সম্পর্কের টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বছর শেষে এসে সেই সম্পর্কের শক্তি নতুনভাবে যাচাইয়ের মুখে দাঁড়িয়েছে।
ইইউর হিসেব অনুযায়ী আগামী বছর ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সত্তর বিলিয়ন ইউরোরও বেশি আর্থিক সহায়তা দিতে হবে যাতে দেশটি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্রমাগত চাপের যুদ্ধের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে। এই বিপুল সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া সম্ভব নয় কারণ সেখানকার প্রশাসন নতুন সামরিক তহবিল অনুমোদনের উদ্যোগ নেয়নি। ইউক্রেনের দরকষাকষির ক্ষমতা পুরোপুরি নির্ভর করছে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্যের উপর। রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনের প্রতিরোধের নেপথ্যের সম্পদশক্তিকে নিঃশেষ করা এবং একই সঙ্গে ইউরোপীয় মিত্রদের অঙ্গীকারকে দুর্বল করা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বর্তমানে কিয়েভের সঙ্গে আট বিলিয়ন ডলারের নতুন ঋণ বিষয়ে আলোচনা করছে। তবে সংস্থাটি স্পষ্ট জানিয়েছে যে তাদের সিদ্ধান্ত বড় ধরনের প্রভাবিত হবে ইইউ কতটা অর্থ জোগাড় করতে পারে তার ওপর। বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী বসন্তের মধ্যেই বড় ধরনের আর্থিক সংকট তৈরি হতে পারে যা সেনাবাহিনীসহ সাধারণ নাগরিক সেবার জন্য বরাদ্দ তহবিলকেও অনিশ্চয়তায় ফেলে দেবে। এতে শুধু প্রতিরক্ষা দুর্বল হবে না বরং দেশের অভ্যন্তরীণ মনোবলেও বড় ধাক্কা লাগবে। তবুও ব্রাসেলসের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত পরিস্থিতির গুরুত্ব দেখে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ইউরোপীয় কাউন্সিলের অক্টোবরের বৈঠক থেকে শুরু করে কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছে তথাকথিত একশ চল্লিশ বিলিয়ন ইউরোর ক্ষতিপূরণ ঋণ প্রকল্প নিয়ে। এই অর্থ রাশিয়ার বরফজমানো সম্পদ থেকে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু সম্পদগুলো বেলজিয়ামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা থাকার কারণে আইনগত জটিলতা দেখা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে সদস্যরাষ্ট্রগুলো নিজেদের মাঝে সাধারণ ঋণ ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল তুলতে পারে। উত্তর ইউরোপের মিতব্যয়ী দেশগুলো এই ধারণায় খুব একটা আগ্রহী নয়। তবুও কমিশনের প্রধান স্পষ্ট জানিয়েছেন যে নিখুঁত বা খুব সহজ কোনো সমাধান এখানে নেই।
বছরের শেষ কাউন্সিল বৈঠকের আগেই সিদ্ধান্ত হওয়া জরুরি। পোল্যান্ডে রেল নেটওয়ার্কে নাশকতার ঘটনা এবং দেশটির অভিযোগ যে কয়েকজন ইউক্রেনীয় নাগরিক রুশ গোয়েন্দাদের হয়ে কাজ করেছে এই ঘটনাটি আরও একবার বুঝিয়ে দিয়েছে রাশিয়া ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোতেও নানা ধরণের আড়ালিভাবে হামলা চালাতে পারে। তাই ইউক্রেনের নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করা মানে ভবিষ্যৎ ইউরোপকেই সুরক্ষা দেওয়া। রুশ নেতৃত্ব এমন এক সমীকরণ তৈরি করতে চায় যাতে তারা ইইউর পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়।
এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান আবারও ইউরোপের রাজধানীগুলোতে সমর্থন যাচাইয়ের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। চতুর্থ শীতের লড়াই সামনে রেখে তিনি প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে তৎপর হলেও ইউক্রেনের জ্বালানি খাতে দুর্নীতির একটি নতুন কেলেঙ্কারি তার প্রচেষ্টাকে কঠিন করে তুলেছে। দেশটি ইইউর সদস্যপদ আলোচনায় অগ্রসর হতে চাইলেও এই ঘটনায় তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে যে হতাশাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে এখন তার সুস্পষ্ট প্রতিকার দরকার ইউরোপ থেকে। রাশিয়ার নেতৃত্ব বিশ্বাস করে প্রয়োজনে তারা ইউক্রেন এবং ইইউ উভয়কেই ক্লান্ত করে তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে। এই ধারণা ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব এখন ইউরোপীয় নেতাদের হাতে।



