ইউক্রেনে ওয়াইন তৈরির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। দেশের মাটিতে শেকড় গেঁথে আছে এমন সংস্কৃতি, যা যুগ যুগ ধরে ধরে এসেছে। এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন দেশটির নানা ওয়াইন উৎপাদক।
ইউক্রেনের একজন উত্সাহী ওয়াইনপ্রেমী, যিনি রাজধানীতে ওয়াইন বার চালান এবং শুধু দেশীয় উৎপাদিত ওয়াইনই সরবরাহ করেন, বলেন, “আমার লক্ষ্য হলো দেশীয় ওয়াইনকে সমৃদ্ধ করা এবং এই শিল্পে বিপ্লব আনা।” তিনি নিজের গ্রামাঞ্চলে আঙ্গুর চাষ ও ওয়াইন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
ইউক্রেন, মলডোভা, রোমানিয়া, জর্জিয়া ও আজারবাইজানসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর মতো বহু যুগ ধরে উর্বর মাটি ওয়াইন উৎপাদনের জন্য পরিচিত। প্রাচীন খ্রিস্টপূর্ব ১১ থেকে ৯ শতকে আঙ্গুরের চাষ ও ওয়াইন তৈরির নিদর্শন পাওয়া গেছে। ক্রিমিয়ার দক্ষিণ উপদ্বীপে অবস্থিত বহু আঙ্গুর ক্ষেত্রই প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ। তবে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার অনৈতিক দখলের পর অনেক আঙ্গুর ক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণসংখ্যক আক্রমণের পর দেশটির আরও অনেক ওয়াইনারি ধ্বংস হয়েছে। কিছু ওয়াইনারি সাময়িকভাবে দখলও হয়েছে। এর ফলে দেশটির ওয়াইন উৎপাদনের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তবে দেশীয় ওয়াইন উদ্যোক্তারা শিল্পকে শুধু বাঁচাতে নয়, বরং বিকশিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই প্রচেষ্টা দেশীয় পরিচয়কে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যকেও সমর্থন করে। দেশের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ওয়াইন উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার মাধ্যমে তারা নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে চান।
ইউক্রেনের ওয়াইন শিল্পের জন্য লন্ডনে বসবাসরত একজন উদ্যোক্তা দেশীয় ওয়াইন যুক্তরাজ্যে প্রচার করছেন। তিনি বিভিন্ন ওয়াইন মেলায় অংশগ্রহণ করে দেশীয় ওয়াইনকে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিত করতে চেষ্টা করছেন। প্রাথমিকভাবে ওয়াইনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, তবে কয়েকজন উদ্যোক্তার প্রচেষ্টায় ইউক্রেনের ওয়াইন আন্তর্জাতিক মেলায় প্রশংসিত হয়।
ইউক্রেনের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যও ওয়াইন উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের মাটির বিভিন্ন ধরন, যেমন কালি, চুনাপাথর, আগ্নেয়প্রভৃতি, এবং ৪০০-এরও বেশি আঙ্গুর প্রজাতি দেশীয় ওয়াইনের স্বাদকে সমৃদ্ধ করছে। এই বৈচিত্র্য আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়।
তবে ইউক্রেনের ওয়াইন শিল্প এখনও আন্তর্জাতিকভাবে আরও পরিচিতি অর্জনের পথ চলা শুরু করেছে। অতীতে, সোভিয়েত যুগে ওয়াইন শিল্পের মানের চেয়ে পরিমাণকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সময় আঙ্গুরের ক্ষতিকর কীটফল ব্যবস্থাপনার অভাবও শিল্পকে প্রভাবিত করেছিল।
বর্তমান যুদ্ধের সময়ও দেশটি তার সাংস্কৃতিক ও জাতীয় পরিচয় রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশীয় ওয়াইনের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
একটি বিশেষ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানী শহরে শহরের বিভিন্ন স্থানে আঙ্গুর চাষ করে স্থানীয়দের সঙ্গে মিলিত হয়ে ২০০ কেজি আঙ্গুর সংগ্রহ করে তৈরি হয়েছে প্রায় ১০০ বোতল প্রাকৃতিক ওয়াইন। এর বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তার জন্য দান করা হয়েছে।
দেশীয় উৎপাদিত ওয়াইন কেবল মানসম্পন্ন নয়, বরং এটি জাতীয় গর্ব ও ঐতিহ্যকে সজীব রাখার প্রতীক। উদ্যোক্তারা আশা করছেন এই প্রচেষ্টা দেশীয় ওয়াইনকে নতুনভাবে স্বীকৃতি এনে দেবে এবং দেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করবে।



