১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে ঘটে এক অভূতপূর্ব গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ গোপনে একটি বিশেষ দল পাঠায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের শীর্ষ নেতা খালেদ মেশালকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। ছয়জন এজেন্টের এই দল বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁকে নিঃশব্দে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। তবে শেষ মুহূর্তে ব্যর্থ হয় তাদের পরিকল্পনা এবং আটক হয় দুইজন এজেন্ট। ইতিহাসে এটিকে মোসাদের অন্যতম বড় ব্যর্থ অভিযান হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলকে চরম কূটনৈতিক সংকটে পড়তে হয়। অন্যদিকে জর্ডানের তৎকালীন বাদশাহর কাছে এটি ছিল কূটনৈতিক বিজয়। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেশালের রাজনৈতিক জীবন নতুন মোড় নেয়।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে জেরুজালেমে হামাসের আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে। এতে বহু ইসরায়েলি হতাহত হয়। প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জরুরি বৈঠক ডাকেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, হামাসের এক শীর্ষ নেতাকে হত্যা করা হবে। শুরুতে অন্য একজনকে লক্ষ্য করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সমস্যার সম্ভাবনা থাকায় শেষ পর্যন্ত মোসাদের তৎকালীন পরিচালক খালেদ মেশালকে হত্যার প্রস্তাব দেন এবং অনুমোদন পান।
কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—মেশালের অবস্থান। তিনি তখন জর্ডানের রাজধানী থেকে হামাসের কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। ১৯৯৪ সালে জর্ডান-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় সরাসরি হামলার সিদ্ধান্ত নিতে সময় লেগেছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বরের শুরুতে আরেক হামলার পর দ্রুত পরিকল্পনা করা হয়।
মোসাদের এজেন্টরা নীরবে জর্ডানে প্রবেশ করে, হোটেলে অবস্থান নেয় এবং বিশেষভাবে তৈরি বিষ সঙ্গে রাখে। এই বিষে আক্রান্ত হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোমায় গিয়ে মৃত্যু ঘটত। এক নারী এজেন্টের কাছে রাখা হয়েছিল প্রতিষেধক, যাতে ভুলক্রমে নিজেদের কারও গায়ে লাগলে তাঁকে বাঁচানো যায়।
২৫ সেপ্টেম্বর সকালে মেশাল যখন অফিসে প্রবেশ করছিলেন, তখন এজেন্টরা তাঁর ঘাড়ে বিষ স্প্রে করার চেষ্টা করে। তবে তাঁর দেহরক্ষীর সতর্কতায় বিষটি কানে লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যে মেশাল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ঘটনার পরপরই মোসাদের দুই এজেন্ট ধরা পড়ে। এ খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। জর্ডানের বাদশাহ সরাসরি ইসরায়েলকে দায় স্বীকার করতে বলেন এবং প্রতিষেধক সরবরাহের আলটিমেটাম দেন। তিনি হুঁশিয়ারি দেন, মেশাল মারা গেলে শান্তি চুক্তিও ভেঙে যাবে।
অবশেষে তীব্র চাপের মুখে ইসরায়েল প্রতিষেধক সরবরাহ করতে বাধ্য হয়। চিকিৎসা নেওয়ার পর মেশাল সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে বিষয়টি সেখানেই থেমে যায়নি। জর্ডান শর্ত দেয়—আটক মোসাদ এজেন্টদের মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনের আধ্যাত্মিক নেতা ও হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনসহ ৫০ জন বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে।
ইসরায়েল দীর্ঘ দরকষাকষির পর এই শর্ত মেনে নেয়। কয়েক দিনের ব্যবধানে বন্দী বিনিময় সম্পন্ন হয় এবং ইতিহাসে এটি ‘হেলিকপ্টার ডিপ্লোমেসি’ নামে খ্যাত হয়।
এই অভিযানের ব্যর্থতা শুধু মোসাদের জন্য নয়, ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জন্যও ছিল বড় কূটনৈতিক ধাক্কা। অন্যদিকে মেশাল বেঁচে যাওয়ার পর হামাসের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।