যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই নিষিদ্ধের তালিকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রখ্যাত লেখক স্টিফেন কিং। “পেন আমেরিকা” নামের সংস্থা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে “Banned in the USA” শীর্ষক প্রতিবেদন, যেখানে দেখা গেছে ২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষে দেশজুড়ে ৬,৮০০–এরও বেশি ক্ষেত্রে বই সাময়িক বা স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যদিও এই সংখ্যা গত শিক্ষাবর্ষের তুলনায় কম (২০২৩–২৪ সালে ছিল ১০,০০০–এরও বেশি), তবে তা আগের কয়েক বছরের তুলনায় এখনও অনেক বেশি।
সংস্থাটির তথ্যমতে, মোট নিষিদ্ধ বইয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই এসেছে মাত্র তিনটি রাজ্য থেকে — ফ্লোরিডা, টেক্সাস এবং টেনেসি। এসব রাজ্যে বই প্রত্যাহারের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন বা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে ইলিনয়, মেরিল্যান্ড ও নিউ জার্সির মতো রাজ্যগুলোতে বই নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সীমিত করার আইন রয়েছে, ফলে সেখানে এই ধরনের ঘটনা প্রায় অনুপস্থিত।
পেন আমেরিকার “Freedom to Read” কর্মসূচির পরিচালক জানান, “এটা এখন যেন দুই দেশের গল্প। শুধুমাত্র লাল কিংবা নীল রাজ্যের পার্থক্য নয়—একই রাজ্যের মধ্যেও জেলা ভেদে পরিস্থিতি ভিন্ন।”
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্টিফেন কিংয়ের বই ২০৬ বার সেন্সর করা হয়েছে। তাঁর জনপ্রিয় বই “Carrie” এবং “The Stand” সহ মোট ৮৭টি কাজ এর আওতায় পড়েছে। অন্যদিকে, নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকার শীর্ষে রয়েছে অ্যান্থনি বার্জেসের ক্লাসিক “A Clockwork Orange”, যা ২৩ বার নিষিদ্ধ হয়েছে। এছাড়াও, প্যাট্রিসিয়া ম্যাককরমিকের “Sold”, জুডি ব্লুমের “Forever”, জেনিফার নিভেনের “Breathless” সহ লেখিকা সারা জে. মাস এবং জোডি পিকোল্টের বহু বইও এই সীমাবদ্ধতার আওতায় এসেছে।
বই নিষিদ্ধ করার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে LGBTQ+ বিষয়বস্তু, বর্ণবাদ–সংক্রান্ত আলোচনা, সহিংসতা ও যৌন সহিংসতার বিবরণ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই বইগুলো সরাসরি অভিযোগ বা চাপ ছাড়াই আগেভাগে প্রত্যাহার করা হচ্ছে—এক ধরনের “ভয়ে আগাম আনুগত্য দেখানো” মনোভাব থেকে।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরও সামরিক পরিবারের জন্য নির্ধারিত K–12 স্কুল লাইব্রেরি থেকে শতাধিক বই সরিয়ে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে তারা “অন্যায্য চিন্তাভাবনা ও DEI (Diversity, Equity and Inclusion) বিরোধী উদ্যোগ” হিসেবে যুক্তি দেখিয়েছে।
ফ্লোরিডায় গত বছরই দুই হাজারেরও বেশি বই নিষিদ্ধ বা সীমিত করা হয়েছে। সেখানকার কয়েকটি কাউন্টিতে স্টিফেন কিংয়ের বহু বই সরিয়ে ফেলা হয়, কারণ কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল সব বই যেন রাজ্যের নতুন আইন অনুযায়ী থাকে। এই আইনে “প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়বস্তু” বা “যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ” বই নিষিদ্ধের আহ্বান জানানো হয়েছিল, যা পরোক্ষভাবে LGBTQ+ বা বর্ণ–ভিত্তিক বিষয়াবলী সম্বলিত বইগুলোকেও প্রভাবিত করেছে।
পেন আমেরিকার প্রতিবেদনের সংখ্যাগুলো অন্যান্য সংস্থা যেমন “আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন (ALA)”–এর হিসাব থেকে অনেক বেশি। এর কারণ, পেন সংস্থা যে কোনো সময়ের জন্য প্রত্যাহার বা সীমাবদ্ধ হওয়া বইকেও গণনা করে, যেখানে ALA কেবল স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ বইগুলোকেই হিসাব করে।
তবে উভয় সংগঠনই স্বীকার করেছে যে তাদের তথ্য সম্পূর্ণ নয়। অনেক রাজ্যের (যেমন ওহাইও, ওকলাহোমা, আরকানসাস) ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নথি পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আসলে বই নিষিদ্ধের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
প্রতিবেদনের একজন লেখক জানান, “এখন বই নিষিদ্ধের সঙ্কটের পরিধি নির্ধারণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক রাজ্যে আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কতগুলো স্কুলে তা কার্যকর হয়েছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। আমরা যা জানি, তা কেবল প্রকাশ্য তথ্যের ভিত্তিতে।”
এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শিক্ষার পরিবেশে গভীর প্রভাব ফেলছে। অনেক শিক্ষাবিদ আশঙ্কা করছেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জ্ঞান ও মুক্ত চিন্তার সুযোগ হারাবে।



