সৌদি আরবের শীর্ষ পর্যায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফর ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনায় এসেছে এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার ইস্যু। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নেন তিনি। ২০১৮ সালের পর এটাই যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রথম সফর, যা দুই দেশের দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ককে আরও জোরদার করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ওয়াশিংটনে এই সফরের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শক্তিগুলোর একটি সৌদি আরবের ৪৮টি অত্যাধুনিক এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার আগ্রহ। বহু বছর ধরে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করতে চাইলেও আগের প্রশাসনগুলো বিভিন্ন কারণে তেমন সাড়া দেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের আপত্তিই ছিল এর প্রধান বাধা। রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম ‘স্টেলথ স্ট্রাইক ফাইটার’ শ্রেণির এই যুদ্ধবিমানের নির্মাতা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন। তাদের ভাষ্যমতে, এফ–৩৫ লাইটনিং টু হল বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোর একটি।
ইসরায়েলের তীব্র আপত্তির মধ্যেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বর্তমান মার্কিন প্রশাসন সৌদি আরবকে এফ–৩৫ সরবরাহের নীতিগত অনুমোদন দিতে প্রস্তুত বলে জানানো হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টও প্রকাশ্যে এই বিক্রি অনুমোদনের কথা জানিয়েছেন। ফলে প্রথমবারের মতো কোনো আরব দেশ এফ–৩৫ চুক্তির আওতায় আসবে এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য অনুমোদিত চুক্তি ২০২১ সালে মার্কিন কংগ্রেসে বাতিল হয়েছিল, এবার সৌদি আরবের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কতটা বদলাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এফ–৩৫ কেন এত বিশেষ তা বোঝা যায় এর নকশা ও প্রযুক্তিতে। রাডার–নজরদারি এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, উন্নত সেন্সর, শক্তিশালী কম্পিউটিং সিস্টেম এবং চারপাশের পরিবেশ থেকে বিপুল তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা এটিকে আকাশযুদ্ধে অনন্য করেছে। ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা সিস্টেমসহ বিভিন্ন সেন্সর থেকে পাওয়া তথ্য সরাসরি পাইলটকে জানানো হয়, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি ও দক্ষতা বাড়ায়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ভাষ্যমতে, এটি যে কোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়।
এই যুদ্ধবিমান নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও ডেনমার্ক অংশীদার হিসেবে যুক্ত রয়েছে। মডেলভেদে এফ–৩৫–এর বিভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত সংস্করণটি হলো এফ–৩৫–এ, যা সাধারণ রানওয়ে ব্যবহার করে ওঠানামা করতে পারে। এফ–৩৫–বি সংস্করণটি অল্প জায়গা থেকে উড্ডয়ন ও হেলিকপ্টারের মতো অবতরণ করতে পারে। ইসরায়েলের জন্য তৈরি এফ–৩৫আই সংস্করণে স্থানীয় প্রযুক্তি যোগ করে রাডার–ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত এফ–৩৫–সি দীর্ঘপাল্লার গোপন অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মূল্যেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা। লকহিড মার্টিনের তথ্য অনুযায়ী আট কোটি থেকে ১১ কোটি ডলার পর্যন্ত একেকটি এফ–৩৫–এর মূল্য হতে পারে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় ২০টি দেশের বহরে বিভিন্ন সংস্করণের এই যুদ্ধবিমান রয়েছে। ইউরোপ, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি শক্তিধর দেশ ইতোমধ্যে এফ–৩৫ ব্যবহার করছে।
এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিজের বহরে যুক্ত করতে সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই আগ্রহী। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় অস্ত্রক্রেতা হিসেবেও পরিচিত। ইরান ও ইসরায়েলকে ঘিরে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রভাব ধরে রাখা এবং সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলায় আকাশসীমায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকে রিয়াদ অত্যন্ত জরুরি মনে করছে। ইয়েমেনের হুতিদের সঙ্গে চলমান অস্থিরতা ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য উত্তেজনাও এ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে।
সব মিলিয়ে, সৌদি আরবের এফ–৩৫ সংগ্রহের চেষ্টাকে শুধু অস্ত্র কেনা হিসেবে নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ভারসাম্য পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এই সম্ভাব্য চুক্তি কত দ্রুত বাস্তবে রূপ পায় এবং এর প্রভাব কতদূর বিস্তৃত হয়।



