Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeসম্পাদকীয়অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আড়ালে রাজনৈতিক ঝুঁকি: এক অস্থির বাস্তবতার ইঙ্গিত

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আড়ালে রাজনৈতিক ঝুঁকি: এক অস্থির বাস্তবতার ইঙ্গিত

সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে অর্থমন্ত্রী এমন একটি বার্তা দিয়েছেন যা আসলে সরকারের আসন্ন বাজেট ঘিরে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইঙ্গিত বহন করছে। ভাষণটির মূল বার্তা ছিলো— সরকার অর্থনৈতিকভাবে বাস্তববাদী থাকতে চায়, কিন্তু তার পেছনের হিসাব বলছে ভিন্ন গল্প।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই বক্তব্য মূলত একধরনের পূর্ব ঘোষণা— নভেম্বরের বাজেটে সরকার তাদের আয়কর না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারে। বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে একটি ফাঁক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা অপরিবর্তিত থাকলেও, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এসেছে। বিশেষত, রক্ষণশীল ও সংস্কারপন্থী দলগুলো এখন ব্যয়সংকোচন নীতিকে সামনে রেখে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছে।

অর্থমন্ত্রী চান, জনগণের কাছে এমন একটি বার্তা যাক যে বর্তমান সরকার জনসেবা ও কর্মসংস্থান রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর বিপরীতে, বিরোধীরা যেন মনে হয়— তারা রাষ্ট্রকে সংকুচিত করতে চায়। রাজনৈতিকভাবে এটি একটি শক্তিশালী কৌশল, যদি সম্পদশালীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়। আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতেই হলে, এই ইস্যুটি রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর বলেই মনে করা হচ্ছে।

সাধারণত বাজেট ঘোষণার আগে মন্ত্রীরা খুব কমই প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। কিন্তু এইবার ব্যতিক্রম ঘটেছে। সরকারপ্রধানের জন্য এই বক্তব্য প্রয়োজন ছিল, যাতে বিরোধীদের চাপা প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায়। একইসঙ্গে এটি সরকারের রক্ষণশীল অর্থনৈতিক নীতিকে সংসদে বৈধতা দেওয়ার কাজও করেছে। বিশেষত, দুই-সন্তান কল্যাণ সুবিধা নিয়ে অনুষ্ঠিত সংসদীয় বিতর্কে সরকার কড়া অবস্থান নেয়, যেখানে সরকার চাইলেই একটি নিরপেক্ষ সংশোধনী এনে উত্তেজনা এড়াতে পারত।

অবশেষে সংসদে প্রস্তাবটি ভোটে না গেলেও, অর্থমন্ত্রী তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন— তিনি রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। কিন্তু বাজারের প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। বক্তৃতার পর মুদ্রা ও শেয়ারবাজার উভয়েই নিম্নমুখী হয়েছে, যা দেখায় বিনিয়োগকারীরা এই পদক্ষেপকে ইতিবাচকভাবে নেননি।

বর্তমানে সরকারের ব্যয় জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর অর্ধেকের বেশি ব্যাংক ও পেনশন ফান্ডের সুদ পরিশোধে চলে যায়, যা সরাসরি জনগণের অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয় না। বাকি অংশ দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়, যার সুফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় না।

অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, বেসরকারি খাত এই ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে— উৎপাদন নয়, বরং ঋণনির্ভর ব্যয়ই হতে পারে তাদের একমাত্র উপায়। এই মডেলটি ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের মতো অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যখন পরিবারগুলো আরও দুর্বল আর্থিক অবস্থায় ছিল।

বর্তমানে অনেক পরিবার ঋণের ভারে ক্লান্ত, আবার জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা নতুন করে ব্যয় বাড়াতে পারছে না। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও বিনিয়োগের বদলে শেয়ার পুনঃক্রয় ও মূলধন সঞ্চয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার চেয়ে অর্থ জমিয়ে রাখছে। ফলে যদি সরকার আমদানি-নির্ভর অর্থনীতিতে ঘাটতি কমাতে চায় এবং বেসরকারি খাত ব্যয় না বাড়ায়, তবে স্থবিরতা বা মন্দা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।

অর্থমন্ত্রী একে “স্থিতিশীলতা” বলছেন, কিন্তু এটি মূলত এক ধরনের ঝুঁকি। কারণ রাষ্ট্র যেখানে ব্যয় কমাচ্ছে, সেখানে পরিবারগুলোকে ঋণের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে বলা হচ্ছে। আর বাজারের আত্মবিশ্বাস— সেটি কেবল কাগজে কলমে বিদ্যমান। অতীতে ঋণনির্ভর প্রবৃদ্ধির যে নাটকীয়তা দেখা গেছে, বর্তমান নীতি সেই পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments