যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম থেকে শুরু করে বাড়ি ও গাড়ির খরচ—সবকিছুতেই অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের ওপর। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন নতুন আর্থিক সমাধান সামনে আসছে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো মানুষকে আরও গভীর ঋণের জালে ফেলে দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় এসেছে ৫০ বছরের গৃহঋণের প্রস্তাব। সরকারের এই উদ্যোগটিকে অনেকে “গেম চেঞ্জার” হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি সাধারণ মানুষের জন্য বরং দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ির দাম ঐতিহাসিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ৭ বছরের গাড়ি ঋণ এখন অনেকের পছন্দের বিকল্পে পরিণত হয়েছে। একইভাবে অনলাইন ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো “বাই নাও, পে লেটার” পদ্ধতিকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে, যা ছোটখাটো কেনাকাটার ক্ষেত্রেও ঋণ নির্ভরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অল্প সময়ের জন্য এইসব পদ্ধতি আর্থিক চাপ কমালেও, দীর্ঘমেয়াদে তা ভোক্তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
উদাহরণস্বরূপ, ৫০ বছরের গৃহঋণ মাসিক কিস্তি কমাতে সাহায্য করলেও, এতে সুদের পরিমাণ ৩০ বছরের প্রচলিত ঋণের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, মোট পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে অনেকগুণ। গড়পড়তা একজন আমেরিকানের আয়ুষ্কাল প্রায় ৮০ বছর হওয়ায়, ৩০ বছর বয়সে ঋণ নেওয়া কেউ পুরো ৫০ বছর মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।
একজন আর্থিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, “যতটা সম্ভব দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এড়িয়ে চলাই ভালো। গাড়ির মূল্য ক্রমে কমে যায়, কিন্তু ঋণের বোঝা কমে না। এতে প্রায়ই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যখন গাড়ির বাজারমূল্য ঋণের চেয়ে কম হয়ে যায়—যা কারও জন্যই ভালো নয়।”
এদিকে “বাই নাও, পে লেটার” বা BNPL পদ্ধতি অনেক আমেরিকানকে দ্রুত কেনাকাটার সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু এর ফলে তরুণ প্রজন্ম এমনসব পণ্য কিনছে, যা তারা স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো কিনতে পারত না। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, এই পদ্ধতিতে বিলম্বিত পেমেন্ট বা ডিফল্টের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
ফেডারেল রিজার্ভের এক গবেষণায় জানা যায়, যাদের আর্থিক সক্ষমতা কম বা ক্রেডিট সীমিত, তারা সবচেয়ে বেশি BNPL ব্যবহার করছে—মূলত কারণ এটি ছাড়া তারা কেনাকাটা করতে পারত না।
নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন গৃহঋণ, গাড়ি ঋণ ও শিক্ষাঋণসহ মোট ভোক্তা ঋণের পরিমাণ ১৮.৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩.৬% বেশি। এর মধ্যে শুধু ক্রেডিট কার্ড ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬% হয়ে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের রেকর্ডে পৌঁছেছে।
তৃতীয় প্রান্তিকে গুরুতর ডিফল্ট বা ৯০ দিনের বেশি বকেয়া ঋণগ্রহীতার হার ৩% ছাড়িয়েছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দিয়েছে শিক্ষাঋণ পরিশোধে—যার মধ্যে ১৪% ঋণগ্রহীতা সময়মতো কিস্তি দিতে পারছেন না।
এই ঋণচাপ মানুষের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ক্রেডিট স্কোরের গড়মানও কমেছে, যা ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার পর সবচেয়ে বড় পতন। স্কোর কমে গেলে নতুন বা পুরনো ঋণ নেওয়া আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, কারণ ঋণদাতারা তখন বেশি সুদ ধার্য করে।
দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকান স্বপ্নের অন্যতম প্রতীক ছিল নিজের বাড়ি। মালিকানা মানে শুধু আশ্রয় নয়, ভবিষ্যতের সম্পদ ও নিরাপত্তা। বাড়ির মূল্য সময়ের সঙ্গে বাড়ে, যা পরবর্তী জীবনে অর্থনৈতিক সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বাড়ির দাম ও সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই এখন সেই স্বপ্ন থেকে সরে আসছেন।
একজন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “গৃহস্বত্ব অর্জন সাধারণ মানুষের সম্পদ সঞ্চয়ের সবচেয়ে সহজ উপায়গুলোর একটি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটি আর সহজ নয়।”
এই বাস্তবতায় “অনারশিপ” ধারণাটিই এখন বদলে যাচ্ছে—ভবিষ্যতের অর্থনীতি হয়তো নির্ভর করবে ব্যবহার, কিস্তি ও সাবস্ক্রিপশনের ওপর; মালিকানার ওপর নয়।



