নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কক্ষ বা এনআইসিইউ-তে (NICU) কর্মরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং শিশুর অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠনের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে এক উদ্বেগজনক প্রবণতা—অভিবাসী অভিভাবকরা ক্রমশ তাদের অসুস্থ নবজাতকদের পাশে থাকতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকেই হাসপাতালের পরিবেশে যেতে সাহস পাচ্ছেন না, এমনকি যাদের বৈধ অভিবাসন অনুমতিও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সংক্রান্ত কঠোর নীতি ও ইমিগ্রেশন এনফোর্সমেন্ট সংস্থার (ICE) কার্যক্রমের আশঙ্কায় বহু পরিবার এখন নিজেদের নবজাতকের চিকিৎসার চেয়েও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতি শুধু পরিবারগুলোর জন্যই নয়, বরং শিশুদের ভবিষ্যৎ বিকাশের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে।
২০১১ সাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে “সংবেদনশীল স্থান” হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যেখানে কেউ চিকিৎসা নিতে এলে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার বা তল্লাশি করতে পারত না। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে এই নীতিটি বাতিল করা হয়। ফলে, এখন হাসপাতালেই অভিবাসী পরিবারদের গ্রেফতারের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা চিকিৎসা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এবং ভয় ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্তের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে নবজাতকদের ওপর। অনেক শিশু এখন হাসপাতালের বিছানায় একা পড়ে আছে, তাদের পাশে নেই মা-বাবা। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞানে বারবার প্রমাণিত—একটি শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশ ও মানসিক স্থিতিশীলতার জন্য পিতামাতার উপস্থিতি অপরিহার্য। এনআইসিইউ শুধু প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসার জায়গা নয়, এটি একধরনের মানসিক ও সামাজিক পরিচর্যার কেন্দ্র, যেখানে শিশুর যত্নে পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নবজাতকের যত্নে ‘স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট’, মা-বাবার কণ্ঠস্বর, মায়ের বুকের দুধ—এসবই সবচেয়ে কার্যকর এবং কম খরচের চিকিৎসা পদ্ধতি। এগুলো শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, শেখার অক্ষমতা ও সেরিব্রাল পালসির ঝুঁকি কমায়। কিন্তু অভিবাসনভীতির কারণে এখন অনেক মা-বাবা এসব প্রাথমিক যত্ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, পিতামাতার অনুপস্থিতিতে নবজাতকেরা বেশি সময় হাসপাতালে থাকে, তাদের মানসিক চাপ বেড়ে যায়, ব্যথা সহ্যক্ষমতা কমে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদে আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। এ ধরনের জটিলতা শিশুর পুরো শৈশবকালজুড়ে স্থায়ী হতে পারে।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও এই ভয় শেষ হয় না। অধিকাংশ অতি-অপরিণত শিশুর নিয়মিত চিকিৎসা ফলোআপের প্রয়োজন হয়—প্রথম কয়েক মাসে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই হাসপাতাল যেতে হয়। কিন্তু এখন অনেক পরিবার এসব ফলোআপ এড়িয়ে যাচ্ছেন, কারণ তারা ভয় পাচ্ছেন, হয়তো কোনো সাক্ষাৎকার বা তল্লাশির মুখোমুখি হতে হবে, কিংবা গ্রেফতার হতে পারেন। কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছেন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে—অসুস্থ শিশুকে চিকিৎসা দেবেন, নাকি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি কমাবেন।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে “প্রটেকটিং সেনসিটিভ লোকেশনস অ্যাক্ট” নামে একটি আইন প্রস্তাবিত হয়েছে, যা হাসপাতালসহ সংবেদনশীল জায়গাগুলোতে অভিবাসন সংস্থার কার্যক্রম সীমিত করার লক্ষ্যে তৈরি। কংগ্রেসে আইনটি এখন আলোচনাধীন, এবং শতাধিক সদস্য এর পক্ষে মত দিয়েছেন। যদি এটি পাস হয়, তবে হাসপাতালের ভেতরে শিশু ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে এবং অভিবাসন পরিস্থিতির কারণে চিকিৎসা ব্যাহত হবে না।
শিশু ও তাদের পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়া শুধু চিকিৎসাবিদ্যার দায়িত্ব নয়, এটি নৈতিক দায়িত্বও বটে। একটি সমাজের মান নির্ভর করে সেই সমাজ কতটা দায়িত্ব নেয় তাদের জন্য, যারা নিজেরা কিছু বলতে পারে না। নবজাতকদের নিরাপত্তা ও যত্ন নিশ্চিত করা মানে একটি সুস্থ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া।



